আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত – (বিস্তারিত আলোচনা) Muhammed Juwel Ahmed
উদ্দেশ্যহীন জীবন যেন ঠিক গন্তব্যহীন যাত্রার মতো।
আপনি কোথায় যাবেন, কি করবেন, কোথায় থাকবেন, এইসব ঠিক না করে যেমন যাত্রার ফল বিরূপ হতে পারে, ঠিক তেমনই উদ্দেশ্যহীন জীবনে আপনি পড়তে পারেন নানা রকমের জানা-অজানা বিপদের সামনে আর, বিপদকে আমরা মনে হয় কেউই খুব একটা পছন্দ করিনা।
এই ধরণের উদ্দেশ্যহীন বিড়ম্বনার হাত থেকে নিজেদের বাঁচতে গেলে আমাদের উচিত জীবনের উদ্দেশ্যগুলোকে প্রথমে ঠিক করে নেওয়া।
আজকে আমাদের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত? – এই বিষয়টি নিয়ে।
প্রথমে জানি, জীবনের উদ্দেশ্য কি ?
জীবনের উদ্দেশ্য কি ?
জীবনের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হল সেই সমস্ত ব্যাপারগুলো, যা আমাদের জীবনধারণের দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে।
আর, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য গুলো প্রধানত জীবনের কেন্দ্রীয় অনুপ্রেরণামূলক লক্ষ্যগুলো নিয়ে গড়ে ওঠে।
আমাদের সবার জীবনেই উদ্দেশ্য কিন্তু একটা মহৎ ভূমিকা পালন করে।
মূলত, উদ্দেশ্য আমাদের জীবনের সিদ্ধান্তগুলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
তাই, আমাদের এই উদ্দেশ্য নির্বাচনের উপর নির্ভর করেই আমরা নানান আচরণ করে থাকি, যেমন- উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে আমরা জীবনের লক্ষ্যগুলোকে সঠিক আকৃতি দিতে পারি, কোনো একটি নির্দিষ্ট পথে ধাবিত হতে পারি কিংবা আমরা নিজেদের জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করতে পারি।
কিছু মানুষের জন্য যেমন উদ্দেশ্যগুলো পেশার সাথে সম্পর্কিত; অর্থাৎ তারা মনে করেন সন্তোষজনক ও কঠোর পরিশ্রম তাদের জীবনের প্রধানতম উদ্দেশ্য।
আবার অন্যদিকে, কিছু মানুষের উদ্দেশ্য থাকে তাদের পরিবার বা বন্ধুদের প্রতি সদা দায়িত্ববান থাকা।
এছাড়াও, অনেক মানুষ আছেন, যারা আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে জীবনের অর্থ খোঁজাকেই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
আবার, অনেক মানুষেরই এই সমস্ত দিকগুলোর মধ্যে তাদের জীবনের উদ্দেশ্যগুলো স্পষ্টভাবে নিহিত থাকে।
আর, জীবনের উদ্দেশ্যগুলো কিন্তু প্রত্যেক মানুষের কাছে আলাদা ও অনন্য হতে পারে।
আপনার উদ্দেশ্যগুলো অন্যদের উদ্দেশ্যের সাথে মিলতেও পারে, আবার নাও মিলতে পারে।
এবং, খুব অদ্ভুতভাবেই মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের উদ্দেশ্যগুলোও তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে সাথে বদলে যেতে পারে, তাদের চাহিদা বদলে যেতে পারে কিংবা জীবন সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়াও ব্যাপকভাবে পাল্টে যেতে পারে।
যখন আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটা প্রশ্ন আমাদের মাথায় আসে –
১. আমি কে/আমরা করা ?
২. আমার/আমাদের প্রকৃত স্থান কোথায় ?
৩. আমি/আমরা কখন নিজেকে/নিজেদেরকে পরিপূর্ণ বোধ করি ?
আর এইসব প্রশ্নের উত্তর পেলেই আপনি সহজেই আপনার জীবনের উদ্দেশ্যগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন।
তবে, আমাদের মনে হয় যে, সমস্ত মানুষেরই জীবন সম্বন্ধে বেশ কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য থাকা উচিত।
প্রকৃতপক্ষে, যেহেতু আমরা সমাজবদ্ধ জীব, তাই আমাদের মধ্যে যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, আমরা কোনোদিনই সমাজের বাইরে গিয়ে দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারবো না।
এই কারণেই, সমাজকে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বেশ কয়েকটি সাধারণ উদ্দেশ্য থাকা একান্তই প্রয়োজনীয়।
জীবনের উদ্দেশ্যই হল আমাদের জীবনের সবথেকে বড় অবদান:
অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্য অনুসরণ করতে সংকোচ বা দ্বিধা বোধ করেন।
কারণ, তারা মনে করেন, এতে তাদেরকে অন্য মানুষেরা স্বার্থপর বলে মনে করতে পারেন।
তবে, জীবনের আসল উদ্দেশ্য হল আপনার নিজের উদ্দেশ্যগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে সেগুলোকে যথাসম্ভব বিশ্বের সাহায্যের জন্যে ব্যবহার করা।
সেই উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে আপনার সমাধান করার মনোবৃত্তি, কাউকে আনন্দ দেওয়ার প্রবণতা ও আরও অনেক কিছুকেই যুক্ত করা যেতে পারে।
তবে, সেক্ষেত্রে আমাদের সবার কর্তব্য থাকবে কেবল নিজের ও অন্যের মঙ্গলের জন্যেই সেই উদ্দেশ্যগুলোকে যথাযথ কাজে লাগানো।
জীবনে কি কি উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজনীয় ?
জীবনের লক্ষ্য পূরণের পিছনে উদ্দেশ্য কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এক্ষেত্রে, আমাদের মানব জগৎ, জীবনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্যে বেশ কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য বানিয়েছে, যা যেকোনো মানুষের লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে, একটা বড় অবলম্বন হিসেবে কাজ করে থাকে; সেগুলো হল –
১. জীবনের সাধারণ নীতি ও ধর্ম পালন:
জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রতিটা মানুষের প্রধান কর্তব্য হল একজন সচেতন মানুষ হিসেবে নিজের আশেপাশে থাকা পরিবেশ, সমাজ, থেকে শুরু করে পরিবার ও দেশের প্রতি কর্তব্যশীল হওয়া।
এছাড়াও, মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোও কিন্তু আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি হওয়া উচিত।
দয়া-মায়া ও ক্ষমাশীল হয়ে ওঠা যেকোনো মানুষের সাধারণ উদ্দেশ্যের মধ্যেই পড়ে।
২. সৎ চরিত্র গঠন করা:
সত্যবান হওয়া ও মানুষের সাথে সৎভাবে মেশা ও একনিষ্ঠভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করা আমাদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্যের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
একজন আদর্শ মানুষ কখনওই তার সংস্কারকে বিসর্জন দিয়ে অসৎ পথে হাঁটতে পারে না।
তাই, আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য থাকুক, নিজেকে একজন সৎ ও সত্যবাদী মানুষ হিসেবে সমাজের সামনে তুলে ধরা।
৩. অর্থ উপার্জনের যথার্থ ব্যবস্থা করা:
আমাদের সমাজে অর্থ উপার্জন না করলে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান করা একেবারেই সম্ভব নয়।
তাই, বর্তমান যুগের মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত সৎ উপায়ে ও পরিশ্রমের দ্বারা অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করা।
উপার্জিত অর্থ সবসময়েই নিজের চাহিদামতো খরচ করার পর সঞ্চয় করা উচিত।
তা নাহলে সেই অর্থের বিনিময়ে কোনো অভাবী ব্যক্তির সাহায্য করলেও, তা যথেষ্ট পুণ্যের কাজ হিসেবে সমাজে গৃহীত হয়।
৪. লোভ সংবরণ করা:
মানুষের জীবনে যেকোনো লক্ষ্যই থাকতে পারে।
কিন্তু, মানুষের সবথেকে বড় ভুল তখনই হয়, যখন সে লোভের বশবর্তী হয়ে এমন কাজ করে ফেলে যা তার নিজের তো বটেই বরং অন্যেরও ক্ষতি করে।
তাই, আমাদের সবারই উচিত লোভ সংবরণের চিন্তা-ভাবনাকে জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।
লোভের শিকার হলে মানুষ নিজের প্রকৃত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে ও দুষ্কর্মের দিকে নিজেকে ঠেলে দিয়ে নিজের তথা নিজের কাছের মানুষগুলো জীবনও নষ্ট করে ফেলে।
তাই, আমাদের উচিত লোভের প্রলোভনে পা না দিয়ে লোভের মায়া জাল থেকে শত হস্ত দূরে থাকা।
৫. এই জীবন হল মোহমায়া – তাই শান্তিই হল পরম সাধনা:
লালসা, ক্রোধ, লোলুপতা, দাম্ভিকতা, আসক্তি, ও ঈর্ষা- এই ছয়টি রিপু হল মানুষের সবথেকে বড় শত্রু।
তাই, আমাদের উচিত এই ছয় ধরণের চারিত্রিক দূর্বলতা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে শান্তি লাভের পথ খুঁজে বের করা।
আমাদের জীবন সাময়িক আর মৃত্যু হচ্ছে নির্মম সত্য।
তাই, আমরা যত তাড়াতাড়ি জাগতিক মোহমায়া ত্যাগ করতে পারবো, ততই আমরা আমাদের মনের শান্তি ফিরে পাবো।
এই কারণেই, সুখ পেতে গেলে আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সমস্ত জাগতিক মায়ার উর্ধে উঠে নিজের মনকে শান্ত রাখা।
পরিশেষে:
সভ্যতার শুরু থেকেই বিবর্তন হল যেকোনো জীবন্ত প্রাণীর সাথে ঘটে চলা একটা সাধারণ ব্যাপার।
আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম সূত্রই হল অভিযোজন; অর্থাৎ, আমরা প্রথমে শিখি, তারপর পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিই ও অবশেষে বেড়ে উঠি।
আর এই অভিযোজনই বয়ে আনে আমাদের সুস্বাস্থ্য, সুখ ও দীর্ঘায়ু।
আর, যেহেতু জৈবিক বিবর্তন হল আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রধান কারণ; সেক্ষেত্রে, আমরা মনে করি, যে আমাদের জীবনের সবথেকে মুখ্য একটি উদ্দেশ্য হল শেখা ও বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের জীবদ্দশায় শারীরিক তথা মানসিকভাবে বিকশিত হয়ে ওঠা।
আমাদের জীবনের দিন খুবই সীমিত, তাই সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, প্রত্যেক দিন আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আগের দিনের চেয়ে একটু ভালো হওয়ার বা ভালো থাকার চেষ্টা করা।
আজকের আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে লিখা লেখাটি পছন্দ হলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।
এছাড়া, আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে সেটাও কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারবেন।
কোন মন্তব্য নেই