ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় গুলো – ( ১০ টি উপায় )
ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় গুলোর বিষয়ে আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করতে চলেছি।
“প্রযুক্তি আমাদের সম্পর্ককে শেষ করে চলেছে, কারণ আমরা আমাদের কাছের মানুষদের চেয়ে আমাদের ফোনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি।” – (প্রচলিত উক্তি)
রাতদিন ফোনে বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে মানুষকে, হয় পেশার খাতিরে আর না হয় নেশার খাতিরে।
আর এই ঘটনা সারা বিশ্ব তথা ভারতের প্রায় প্রতিটা ঘরের জন্যেই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা নিত্যদিনের চিত্র।
কেউ হয়তো ল্যাপটপে অনলাইন অফিসের কাজ শেষ করে সোজা খুলে ফেলছে নেটফ্লিক্সের মতো কোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম শুধুমাত্র দিনের শেষে একটু বিনোদন লাভের আশায়।
আর, কেউবা স্কুলের টিউশন শেষ না হতেই বুঁদ হয়ে যাচ্ছে অনলাইন গেমিং-এর নেশায়।
অনেকেই আবার ঘন্টার পর ঘন্টা পার করছে সোশ্যাল মিডিয়া প্যালটফর্মে কিংবা ইউটিউবে।
এক ঘরে, তিনটে মানুষ বাবা, মা ও সন্তান থাকলেও, তারা সবাই ব্যস্ত যে যার মোবাইল ফোন ও ইন্টানেট জগৎ নিয়ে।
তাদের দু-দণ্ড সময় নেই একে অপরের সাথে কথা বলার কিংবা নিজেদের সুখ-দুঃখ বা আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার।
তারা রাতদিন ব্যস্ত ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত বিনোদনের নেশায়।
আর, এই নেশাতে আবদ্ধ করেই মানুষের সম্পর্ক গুলোকে খেয়ে ফেলছে এই ইন্টারনেট মাধ্যম।
আর, আজকে আমাদের এই আর্টিকেলের আলোচনার বিষয়ই হল, ইন্টারনেট আসক্তি এবং এই আসক্তির থেকে মুক্তির উপায়।
ইন্টারনেট আসক্তি কি ?
আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, যে মানুষের জীবনে অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।
ঠিক তেমনই, মাত্রাতিরিক্তভাবে ইন্টানেটের ব্যবহার আপনাকে করে তুলতে পারে ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত।
আসলে, এই ইন্টারনেটের আসক্তি কি জিনিস, এই বিষয়ে বলে দিচ্ছি চলুন।
প্রকৃত অর্থে, ইন্টারনেট আসক্তি হল অতিরিক্ত ভাবে বা সীমাহীন ভাবে যথেচ্ছ কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার, যা মানুষের আচরণে ও শরীরে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
কিংবা, অতিরিক্ত মাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহার, যা মানুষকে প্রতিবন্ধকতা বা কষ্টের দিকে ঠেলে দিতে পারে, আর সেই অতিরিক্ত ইন্টানেটের ব্যবহারকেই আমরা ইন্টানেটের প্রতি চরম আসক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
ইন্টানেট আসক্তির লক্ষণ:
আপনি যখন কোনো কিছুর নেশা করেন, তখন সেই নেশা আপনাকে বারবার টানে।
অর্থাৎ, আপনি সেই নেশার ঝোঁকে, বারবার সেই নেশা করতে চান।
ইন্টারনেট আসক্তিও সেই না-ছোড়-বান্দা নেশারই মতো।
মানে, আপনি মন থেকে হয়তো মোবাইল ঘাঁটতে চাইছেন না, কিন্তু আপনি বারবার আপনার ফোন এর লকস্ক্রিন খুলে কোনো না কোনো এপ্লিকেশনে ঢুকে পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নিজের অজান্তেই পার করে ফেলছেন।
কিন্তু, সেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় যা আপনি ইন্টানেট মাধ্যমে কাটাচ্ছেন, তা কিন্তু আসলে কোনোদিনও ফেরত আসবে না।
উল্টে কিন্তু, আপনার শরীর ও মনের উপরও পড়বে তার ক্ষতিকর প্রভাব।
একজন মানুষের সুস্থ থাকার জন্যে প্রয়োজন সারাদিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টার পর্যাপ্ত ঘুম ও সময়মতো খাওয়া-দাওয়া।
কিন্তু, আপনি আপনার সারাদিনের কাজ বন্ধ রেখে কিংবা রাতের ঘুমকে বলিদান দিয়ে দিনের পর দিন যে ইন্টারেনট মাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করছেন, সেটা কিন্তু আপনার অজান্তেই আপনার ইন্টারেনট আসক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আর, এই ইন্টারনেট আসক্তির নানা ধরণের প্রভাব আপনার মনে ও শরীরে পড়তে পারে।
সেগুলো হল জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়া, মুড সুইংস হওয়া, একাকিত্ব অনুভব করা, অপরাধবোধ কাজ করা, সময়জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
এমনকি, একটানা একই জায়গায় বসে থেকে ইন্টারনেট চালালে কোমরে, পিঠে ও ঘাড়ে ব্যথার মতো নানা ধরণের আরও জটিল শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
তবে, সব মুস্কিল থেকে বেরোনোর যেমন উপায় রয়েছে, তেমনই ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তিরও রয়েছে বেশ কতগুলো প্রভাবশালী উপায়।
ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় গুলো
ইন্টারনেটের নেশা থেকে মুক্তির উপায় গুলোর মধ্যে জরুরি কতগুলো উপায় নিচে আলচনা করা হল –
১. প্রয়োজন ছাড়া ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট থেকে দূরে থাকুন:
ইন্টারনেট আসক্তি কাটাতে হলে প্রথমেই আপনাকে মনের দিক থেকে শক্ত হতে হবে।
নিজেকে নিজে চ্যালেঞ্জ করুন, যে আপনি যদি নিয়মিত দিনে ১০ ঘন্টা করে ইন্টারনেট ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করেন।
তবে, চেষ্টা করুন প্রথম সপ্তাহে সেই দৈনিক ব্যবহার ৯ ঘন্টায় নামিয়ে আনতে।
এরকম ভাবে, প্রতি সপ্তাহে এক ঘন্টা করে দৈনিক ইন্টারনেট ব্যবহার কমিয়ে আনতে থাকুন।
এই চ্যালেঞ্জ জিতলে প্রতি সপ্তাহে জেতার জন্যে নিজেকেই নিজে ভালো কিছু ট্রিট দিন।
আর, এই উপায়ে কাজ নাহলে আপনার বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে তাদের সাথে কিছু মজার একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে দূরে থাকুন।
২. সারাদিনে কয়েক ঘন্টা সময় প্রকৃতির মাঝে থাকুন:
প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক আদিম কাল থেকেই।
আর, প্রকৃতির মধ্যে মানুষ থাকলে, তার মন আপনা থেকেই ভালো হয়ে ওঠে।
তাই, চেষ্টা করবেন, অন্ততপক্ষে, সারাদিনে ঘন্টাখানেক সময় কোনো পার্ক বা সবুজ ময়দানে খোলা হাওয়ার মধ্যে কাটাতে।
কিংবা, আপনি আপনার কোনো সঙ্গীকে নিয়ে লং-ওয়াকেও যেতে পারেন।
এতে, আপনার মন ইন্টারনেট বা কোনো রকমের ডিভাইস থেকে সরে আসবে কিছুক্ষণের জন্যে।
৩. বই বা ম্যাগাজিন পড়ুন:
আপনার ভালোলাগার বিষয় ক্রাইম থ্রিলারও হতে পারে, আবার কমেডিও হতে পারে।
আর, এই পৃথিবীতে অসংখ্য বই ও ম্যাগজিন দুইই রয়েছে।
বই আপনার মনোসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করার পাশাপাশি ইন্টারনেট এডিসিশন কমাতেও সাহায্য করবে।
কারণ, বইয়ের নেশা একবার করতে পারলে, তা আপনার জ্ঞান বাড়ানোর পাশাপাশি সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করবে।
আর, মানুষ যখন কোনো সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন সে মন থেকে খুশি থাকে ও ইন্টারনেট মাধ্যমের ব্যবহারকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে না।
তবে, আপনার অত্যধিক ইন্টারনেট আসক্তি থাকলে কিন্ডলের মতো ই-বুক প্লাটফর্ম থেকে দূরে থাকাই ভালো।
আর, সাইকোলজি বলে, যে বইয়ের ছাপা অক্ষর মানুষের মনোসংযোগ বৃদ্ধিতে সহায়কও বটে।
৪. নতুন ইতিবাচক নেশা তৈরিতে মন দিন:
আজকালকার দিনে ইন্টারনেট ছাড়া থাকা যেমন অসম্ভব, তেমনই কিন্তু এই ইন্টারনেট ব্যবহারকে, আপনি কোনো জ্ঞানবৃদ্ধিমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
আপনি কোনো নতুন ভাষা শিখতে পারেন, নতুন অঙ্কন শৈলী শেখার চেষ্টা করতে পারেন, নাহলে কোনো রান্নার নতুন রেসিপিও শিখতে পারেন।
দেখবেন, যে যান্ত্রিক জীবনের থেকে বাস্তব জীবনে নিজে হাতে নতুন কিছু জিনিস সৃষ্টি করে তার আনন্দ উপভোগ করার মজাই আলাদা।
৫. পোষ্য রাখুন ও তার যত্নে মন দিন:
একাকিত্ব থেকে কিন্তু মানুষের ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি আসাটা মোটেও বিরল ঘটনা নয়।
তাই, আপনি যদি নিজেকে একা অনুভব করেন, অথচ কোনো মানুষের সঙ্গ করতে চাইছেন না।
তবে, সে ক্ষেত্রে আপনার সুবিধা ও পছন্দমতো কোনো পোষ্য রাখতে পারেন।
তার যত্ন-আত্তি, খাওয়া-দাওয়ার পিছনে সময় দিতে গেলে দেখবেন ইন্টারেন্ট থেকে মন অনেকটাই সরে এসেছে।
তবে, অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, কোনোভাবেই যেন আপনার পোষ্যের অযত্ন না হয়, তাহলে কিন্তু বুঝে যাবেন যে আপনার আসক্তি আপনার উপর সম্পূর্ণ থাবা বসানোর চেষ্টা করছে, আর সেক্ষেত্রে কোনো ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করাটা একান্ত প্রয়োজনীয়।
৬. মন খুলে ফোন করুন কিংবা সামনাসামনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন:
অনেক হয়েছে এই হোয়াটস্যাপ ভয়েস নোট, টেক্সট পাঠানো আর স্টেটাস দেখা!
এসব থেকে বেরিয়ে এসে বন্ধু বা প্রিয়জনদের সাথে মন খুলে ফোনালাপ চালান।
দরকার মনে হলে, তাদের সাথে ঘন ঘন দেখা করুন।
আর, কখনোই ভাববেন না যে আপনি একাই এই ইন্টারনেটে আসক্ত,
হয়তো দেখবেন আপনার পাশের ফ্ল্যাটে থাকা কোনো ব্যক্তিও আপনার মতোই ইন্টারনেটে আসক্ত।
তাই, চেষ্টা করুন তাদের সাথেও কথা বলার, যাতে আপনারা একসাথে এই আসক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন।
৭. গান শুনুন বা বা সিনেমা দেখুন:
সবসময় ইন্টারনেট ব্যবহার না করে, কখনও আপনার ঘরের কোণে রাখা রেডিওতে নানাধরণের রেডিও স্টেশনগুলোও শুনে দেখুন।
সেখানেও নানা ধরণের ভালো-ভালো গানের অনুষ্ঠান ও আলোচনার আসর হয়।
যা অনেকটাই সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক মনোভাব তৈরী করতে পারে।
অন্যদিকে, আপনার ঘরে ধুলোপড়া পুরোনো বোকাবাক্সটা চালিয়ে দু’চারটে টিভি প্রোগ্রাম দেখলেও কিন্তু মন ভালোলাগবে।
তাই, রেডিও বা টিভি যেটাতে বেশি মন ভালো হয়, সেটাই দেখুন বা শুনুন, শুধুমাত্র চেষ্টা করুন নিজেকে ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখতে।
৮. নিজের জন্যে সময় বের করুন:
একটার পর একটা ওয়েব সিরিজ দেখতে ভালোলাগলেও, আসলে একটানা সেইসব সিরিজ দেখতে ও শুনতে থাকলে আমাদের মস্তিষ্কের উপর খুব বেশি চাপ পড়ে।
তাই, অবশ্যই চেষ্টা করবেন, সারাদিনে ৩ থেকে ৫টা এপিসোড দেখে, বাকি সময়টা নিজের জন্যে বার করতে।
সেই সময়টা বই পড়লেন, নাহলে নিজের স্কিনকেয়ার রুটিন ফলো করলেন, কিংবা একটু ঘুমিয়েই পড়লেন।
নিজের শরীর ও মনকে রেস্ট দেওয়াটাও কিন্তু সমানভাবে জরুরি।
তাই, নিজেকে যদি ভালোবাসেন তাহলে দিনের বেশিরভাগ সময়টা ইন্টারনেটকে না দিয়ে, নিজের জন্যেও কিছু সময় বাঁচিয়ে রাখুন।
৯. শরীরচর্চা করুন:
অলস শরীর ও মস্তিস্ক দুইই কিন্তু শয়তানের বাসা।
তাই, একনাগাড়ে মোবাইল হাতে বসে না থেকে নিজের শরীরচর্চার প্রতি মন দিন।
আর, ইন্টারনেটের কোনো শেষ নেই, কিন্তু মনে রাখবেন আপনার জীবন একটাই, এই কারণেই সুস্থ শরীরে ও মনে যাতে বাকি জীবনটা সুখে কাটাতে পারেন, তাই চেষ্টা করুন ইন্টারনেট আসক্তি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসতে।
১০. ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে দ্বিধা বোধ করবেন না:
সবসময় আসক্তি থেকে আমরা নিজেরা একা-একা বেরিয়ে আসতে পারি না,
তাই আমাদের সেসব ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সাহায্যের হাতের দরকার হয়।
তাই, যদি মনে করেন, আপনি নিজের ইন্টারনেট আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তবে, অবশ্যই দ্বিধা না করে যত দ্রুত সম্ভব কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন।
তাঁরা তাঁদের বহুমূল্য অভিজ্ঞতা থেকে আপনাকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার অবশ্যই চেষ্টা করবেন।
সবশেষে:
জীবন আসলে কিন্তু হল একটা লড়াই, যেখানে খারাপ-ভালোর দিকের লড়াইটা সব মানুষের ক্ষেত্রেই আলাদা-আলাদা হয়।
আমাদের ভালোদিক যেমন রয়েছে আবার খারাপদিকও রয়েছে।
তাই, খারাপটাকে শুধরাতে চাওয়াটা কোনো পাপ বা গর্হিত কাজ নয়।
তাই, এই খারাপ ইন্টারনেট আসক্তি থেকেও মুক্তিলাভ করতে আমাদের চাই খারাপের বিরুদ্ধে লড়াইটাকে শেষ পর্যন্ত জারি রাখা, যাতে আমরা আর-পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারি।
আমাদের আজকের এই ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে লিখা এই আর্টিকেলটি পছন্দ হলে অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।
কোন মন্তব্য নেই