তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপায়: কিভাবে তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায় ? জুয়েল আহমদ |

আপনি জানেন তো যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সারাদিনে কম করে ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন হয় ?

আপনার কি প্রতিদিন এই পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম হয় ? 

উত্তর, যদি না হয়, তাহলে জেনে রাখা ভালো যে, ঘুম ঠিকমতো না হলে, আপনার শরীর ও মন এমনকি মগজও ঠিকভাবে কাজ করতে অপারোগ হয়। 

আর, অনিদ্রাতে প্রতিনিয়ত ভোগার কারণে আপনার মধ্যে দেখা দিতে পারে ঘুম কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ব্যাধি; যথা- উদ্বেগ, হতাশা, ক্লান্তিভাব, খিটখিটে মেজাজ ও আরও অনেক কিছু। 

হয়তো, আপনি একজন মর্নিং-পার্সন নন, কিংবা কাজ বা পারিবারিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে- যা আপনাকে অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে বাধ্য করে। 

কিন্তু, সারাদিন খাটাখাটনির পর, হয়তো রাতের সময়টুকুই আপনার রিলাক্সেশনের সময় হিসেবে বেঁচে থাকে।

আবার, অন্যদিকে রাতই হল আমাদের ঘুমের একমাত্র সময়। 

তবে যাইহোক, কোনো না কোনোভাবেই রিলাক্সেশনের চক্করে আপনার ঘুমের বারোটা ঠিক বেজেই যায়। 

আর, দেরি করে জেগে থাকার কারণে, তা আপনার পরের দিনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে থাকে।

যদি, আপনার রাত জাগার বদ অভ্যাসকে ত্যাগ করে, তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপায় খুঁজে থাকেন- তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনাকে সাহায্য করতে পারে, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কয়েকটি অব্যর্থ উপায় ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে।

তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপায় | কিভাবে তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়

তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপায়
কিভাবে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারেন ?

সব সময় মনে রাখবেন যে, স্লিপিং হ্যাবিট বা ঘুমানোর অভ্যেস মানুষের মধ্যে একদিনেই তৈরী হয়ে যায় না। 

তাই, একজন লেট স্লিপার হিসেবে, আপনি কখনওই একদিনে বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, নিজের ঘুমানোর অভ্যাস পাল্টে ফেলতে পারবেন না। এই কারণেই, আপনাকে নিজের অভ্যাস পাল্টাতে গেলে, একটা নির্দিষ্ট রুটিন মেনে টানা কয়েক মাস তা ফলো করে চলতে হবে। 

তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার সেরা ৮টি উপায় –

চলুন, তাহলে আমরা এইবার জেনে নিই, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার সেরা উপায়গুলোর সম্পর্কে।

১. একটা সন্ধ্যার রুটিন তৈরি করুন:

বেডটাইম রুটিন শিশু ও কিশোরদের মধ্যে কার্যকরীভাবে অনিদ্রার সমস্যা দূর করতে পারে। 

এছাড়াও, তাড়াতাড়ি ঘুমের অভ্যাস তৈরি করতে ও সামগ্রিকভাবে আরও ঘুম পেতে চাইলে, প্রাপ্তবয়স্কদের ঘুমানোর আগে কিছু আরামদায়ক কার্যকলাপ করা উচিত- যা তাদের স্নায়বিক উত্তেজনাকে কমিয়ে আনতে পারে। 

রাতে আপনার রুটিনে যে সাধারণ আরামদায়ক কার্যকলাপগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন; সেগুলো হল-

– উষ্ণ শাওয়ার নেওয়া বা স্নান করা:

বিছানাতে যাওয়ার আগে, আপনার চাপ কমাতে ও আরাম করতে স্নান করতে পারেন। 

এছাড়াও, গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘুমানোর আগে স্নান করলে তা আপনার শরীরের তাপমাত্রা ৫º পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। 

যা আপনাকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে ও ঘুমের গুণমান উন্নত করতে সাহায্য করে। 

ঘুমোতে যাওয়ার কম করে ১ থেকে ১.৫ ঘন্টা আগে স্নান করবেন।

– ধ্যান: 

শান্ত ও একাগ্র মনোযোগের অভ্যাসগুলো আপনার স্বস্থ্যের পক্ষে ব্যাপকভাবে উপকারী। 

শোওয়ার আগে ১০-১৫ মিনিট ধ্যান, আপনার উদ্বেগ কমিয়ে মনকে শান্ত ও শরীরকে শিথিল করে, ঘুম আনতে সাহায্য করে। 

ধ্যানের মাধ্যমে আপনি অনিদ্রার নানান লক্ষণগুলো কমিয়ে এনে ঘুমের ব্যাঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

– বই পড়া: 

একটানা মনোযোগ দিয়ে কোনো বই পড়লে, তা আপনার মনকে শান্ত করে তন্দ্রা নিয়ে আসতে পারে।  

তবে,অবশ্যই চেষ্টা করবেন, ট্যাবলেটের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পরিবর্তে কাগজের বই পড়ার। 

কারণ, গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, বইয়ের পরিবর্তে ট্যাবলেটে বই পড়লে, তা আপনার ঘুমকে আরও বেশি ব্যাহত করতে পারে।

– গান শোনা: 

মৃদু বা শান্ত মিউজিকও ঘুমানোর আগে আপনার মনকে শান্ত করে। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, ঘুমানোর আগে মৃদু সঙ্গীত শুনলে, তা আপনার স্নায়ুকে শিথিল করে আপনার ঘুমের মান উন্নত করে তোলে।

– ডায়েরি লেখা: 

যদি স্ট্রেস ও ওয়ার্ক প্রেসারের কারণে, আপনি যদি রাতে জাগা থাকেন, তাহলে ডায়েরি লেখার মাধ্যমে আপনি আপনার উদ্বেগগুলো লেখার চেষ্টা করতে পারেন। 

এতে, মানসিক জটিলতাগুলোকে লিখে রাখলে, তা আপনাকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে।

২. একটা নিয়মমাফিক ঘুমের সময়সূচী বজায় রাখুন:

রোজ-রোজ আলাদা সময়ে ঘুমাতে গেলে, তা আপনার ঘুমকে ব্যাহত করে। 

তাই, তাড়াতাড়ি ঘুমানোর সেরা উপায় হিসেবে আপনি একই সময়ে ঘুমানো ও একই সময়ে ওঠার অভ্যাস করুন। 

তাতে, আপনার শরীর একটা নিয়মমাফিক স্লিপিং রুটিন তৈরি করতে পারে। 

প্রতিদিন, আগের দিনের তুলনায় ১৫ মিনিট আগে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস করুন- দেখবেন, আস্তে-আস্তে আপনার ঘুমাতে যাওয়ার রুটিনে পরিবর্তন আসবে। 

আর, ঘুমাতে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে ন্যাপ নেওয়ার অভ্যাস বন্ধ করুন, এতে আপনার রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। 

কারণ, ঘুমানোর ৩০ মিনিট আগে ঘুমালে, তা হঠাৎ করেই আপনার এনার্জি লেভেল কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারে আর ঘুমে ব্যাঘাত আনতে পারে। 

৩. ব্লু লাইট এক্সপোজার নিয়ন্ত্রণ করুন:

ঘুমাতে যাওয়ার আগে, বিছানায় শুয়ে মোবাইল স্ক্রল করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে- যেটা হল আমাদের অনিদ্রার অন্যতম প্রধান কারণ। 

আর, গবেষণাতেও দেখা গেছে যে, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ব্লু লাইট এক্সপোজার, আমাদের শরীরে স্লীপ হরমোন, মেলাটোনিনের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে, ঘুম আসতে বাধা দেয়। 

সুতরাং, ঘুমাতে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে যতটা সম্ভব ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করা একদম কমিয়ে দিন। 

এমনকি, আমাদের ই-বুক, টিভি, কম্পিউটার- সমস্ত ডিভাইস থেকেই এই ব্লু লাইট বেরোয়।  

৪. এক্সারসাইজ করুন:

ফিজিক্যাল ফিটনেসের পাশাপাশি প্রতিদিনের এক্সারসাইজ আপনাকে ভালোভাবে ঘুমাতেও সাহায্য করে। 

অভিজ্ঞদের মতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে-আগে কঠোর এক্সারসাইজ করলে, তা আপনার ঘুমের তেরোটা বাজাতে পারে। 

গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, রাতে জোরদার এক্সারসাইজ করলে তা আপনার অ্যাড্রেনালিন হরমোনকে ব্যাপকভাবে উদ্দীপিত করে- যা আপনার স্নায়ুকে বেশি উত্তেজিত করে তুলে ঘুম দূরে ভাগিয়ে দেয়। 

এছাড়াও, ঘুমাতে যাওয়ার কম করেও ২ ঘন্টা আগে এক্সারসাইজ করে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। 

একদম সকালে এক্সারসাইজ করাই হল সবথেকে ভালো সিদ্ধান্ত। 

৫. একটা আরামদায়ক বেডরুম পরিবেশ তৈরি করুন:

নিজের শোওয়ার ঘরে একটা সুস্থ ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরী করেও ঘুমের মানকে উন্নত করা সম্ভব। 

একটা আরামদায়ক বেডরুমের পরিবেশ তৈরি করতে, আপনি নিচের পদক্ষেপগুলো নিতে পারেন-

– ঘর অন্ধকার করা:

রাতের বেলা ল্যাম্প, লাইট কিংবা যেকোনো আলোর উৎস আপনার ঘুমে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। 

তাই, ঘুমানোর আগে ঘর অন্ধকার করুন, প্রয়োজনে রাস্তার আলো এড়াতে জানলায় ব্ল্যাকআউট পর্দা বা আই মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন।

– তাপমাত্রা কমানো:

গরমের তুলনায় হালকা শীতল ঘরে আমাদের ঘুম তাড়াতাড়ি আসে। 

তাই, আপনি যদি গরম আবহাওয়ায় থাকেন, তাহলে এয়ার কন্ডিশনার, হাই-স্পিড ফ্যান কিংবা ক্যুলার ব্যবহার করতে পারেন। 

আর, আপনার বেডিংটাও সেই আবহাওয়া অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারেন।

– কোলাহল কমানো:

একটা শান্ত বেডরুমের পরিবেশ ঘুমানোর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। 

নিজের ঘুমকে নির্বিঘ্ন করতে ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করে দেখতে পারেন। 

প্রয়োজনে ভারী পর্দা বা জানলা-দরজা বন্ধ করেও শুতে পারেন।

– বেডরুমকে শুধুমাত্র ঘুমানোর জন্যেই ব্যবহার করা:

রাতে ঠিক সময়ে ঘুমাতে গেলে, অবশ্যই বিছানাতে ল্যাপটপ ব্যবহার একেবারেই করবেন না। 

বিছানাকে কেবলমাত্র ঘুমানো ও রেস্ট নেওয়ার কাজেই ব্যবহার করা উচিত। 

আর, শোওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে ঘুম না এলে, অন্য ঘরে গিয়ে কোনো আরামদায়ক কার্যকলাপ করুন- যতক্ষণ না ঘুম আসে।

৬. ন্যাচারাল স্লীপ এইড ব্যবহার করুন:

অনেকগুলো ন্যাচারাল স্লীপ এইড রয়েছে, যা আপনাকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে সাহায্য করতে করতে পারে-

– মেলাটোনিন: 

মেলাটোনিন হল এক ধরণের হরমোন, যা আমাদের ঘুম আনতে সাহায্যে করে। 

তাই, শোওয়ার কিছু আগে মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট নিলে, তা অনেক ব্যক্তিকে ঘুমাতে সাহায্য করে।

– হার্বাল টি: 

প্রাথমিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বেশ কিছু ভেষজ চা আপনার ক্লান্তি কমিয়ে আপনার ঘুমের মানকে উন্নত করতে পারে। 

তবে, মনে রাখবেন যে, রাতে শোওয়ার আগে বেশি পরিমাণে তরল পান করলে, আপনাকে বারবার বাথরুমে যেতে হতে পারে; যা ঘুমের আদতেই ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। 

যেমন- ক্যামোমাইল টি আপনাকে ঘুমাতে সাহায্য করে।

– স্লীপ-ইনডিউসিং সেন্ট:

অ্যারোমাথেরাপি বা সুগন্ধির ব্যবহারের ফলে, অনেক সময়েই অনিদ্রা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। 

যথা- ল্যাভেন্ডারের গন্ধ আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে পারে।

৭. রাতের দিকে ক্যাফেইন বা নিকোটিন এড়িয়ে চলুন:

সিগারেট বা চা-কফির নেশা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। 

কিন্তু, রাতের দিকে এই ধরণের নেশার আপনার ঘুমের সর্বনাশ করে দিতে পারে। 

ঘুমাতে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে, নিকোটিন বা ক্যাফেইন জাতীয় স্টিমুল্যান্ট আপনার স্নায়ুকে বেশি মাত্রায় উত্তেজিত করে দিতে পারে। 

সুতরাং, ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ৩ ঘন্টা আগে চা, কফি, সিগারেট বা চকলেট না খাওয়ারই চেষ্টা করুন।   

৮. সময়ের আগে বিছানায় যান ও সময়ের আগে ঘুম থেকে উঠুন:

ধরুন, আপনি বর্তমানে রাত ১২টাতে শুতে যান। 

তাহলে, আজ থেকে সেই শোওয়ার সময় ১১:৪৫ মিনিটে করুন, তারও পরের দিন ১১:৩০ করুন এবং তারও পরের দিন সেটা ১১:১৫-তে করুন। 

এইভাবে, আপনার স্লিপিং টাইমকে প্রতিদিন একটু-একটু করে আপনার পছন্দের সময়ে নিয়ে আসুন।  

যদি, ঘুমানোর সময় এগিয়ে না আনতে পারেন, তাহলে সময়ের আগে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন। 

এর পিছনে মূল উদ্দেশ্য হল আপনার শরীরকে ক্লান্তবোধ করানো, যাতে আপনি তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান। 

পরিশেষে:

একবার আপনি আপনার ঘুমানোর সময় ঠিক করে নিতে পারলে, এই নির্দিষ্ট রুটিনটিকে ধরে রাখুন। 

প্রকৃতপক্ষে, গবেষণা দেখা যায় যে, নিয়মিত ঘুমানোর অভ্যাস আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। 

দিনের শেষে একটা শান্তির ও গভীর ঘুম, ভালো কার্যক্ষমতা, চাঙ্গা মেজাজ, এবং ফুরফুরে মন ও শরীরের থেকে ভালো আর কি হতে পারে!

আমাদের আজকের ‘কিভাবে তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়?’- নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল। 

আপনি তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্যে কোন পন্থা অবলম্বন করেন, তা অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না । 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.