কেন পড়ব ব্যবস্থাপনা |ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স পড়ে ক্যারিয়ার কি? Muhammed Juwel Ahmed |

Human Resource Management (HRM) বা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা আধুনিক বিশ্বের একটি চৌকস চাকুরী ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা এবং ক্ষেত্র একেবারেই নতুন বলা চলে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে এ পেশার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কর্মক্ষমতার যথার্থ ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়ে বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও 'মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা' বিভাগের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কারণ একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য অর্জন অনেকাংশেই নির্ভর করে সেই প্রতিষ্ঠানটির মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর।

ইতিহাস

"মানব সম্পদ" ধারণাটি যথেষ্টই আধুনিক, গত শতাব্দির প্রথম দিকেও কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের "সম্পদ" হিসেবে দেখা হত না। তারা ছিলেন শুধুই শ্রমিক, উচ্চ পদস্থ কর্তাদের আদেশ পালন করা ছিল তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। ধীরে ধীরে কোম্পানিগুলো দেশে-বিদেশে বিস্তার লাভ করার পর উপলব্ধি করল যে এই বিস্তৃতি ধরে রাখার কান্ডারী হল তাদের কর্মীগণ। একটি প্রতিষ্ঠানের লোকবলই তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই উপলব্ধি থেকেই "মানব সম্পদ উন্নয়ন" ধারণার প্রবর্তন। কোম্পানিগুলো তাদের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা করার জন্য "Personnel Administration" নামক শাখা খুললো, যা পরবর্তীতে "Human Resource Department (HRD)" নামে পরিচিতি পেল। আধুনিক বিশ্বের কোম্পানিগুলোতে কর্মীগণ তাদের উচ্চ-পদস্থদের সাথে নতুন নতুন আইডিয়া সহজেই শেয়ার করতে পারেন এবং কোম্পানিও এই সৃজনশীল মানুষদের বিকাশের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করে থাকে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির হাত ধরে HRD এর যাত্রা শুরু হয় ১৫/২০ বছর আগে। বর্তমানে অনেক বাংলাদেশি নাগরিক এই কোম্পানিগুলোর HRD Head হিসেবে কর্মরত আছেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত মানব সম্পদ উন্নয়ন শাখা চালু করছে, এতে আকর্ষণীয় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।

কাজের ধরণ

প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কর্মপরিধি যাই হোক না কেন মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে কর্মরতদের কাজের ধরণ প্রায় একই রকম। যে কোন প্রতিষ্ঠানেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই বিভাগের কর্মকর্তারা। স্ব- স্ব প্রতিষ্ঠানের লোকবল ও তাদের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সামনে যথাযথ তথ্য উপস্থাপন করাই একজন মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মীর মূল কাজ। যার ফলে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে কর্মরতরা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি সম্মানেরও পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। তাই বাংলাদেশের তরুণদের কাছে এই ক্ষেত্রটিতে কাজ করার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন, প্রশিক্ষণ, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, কর্মীদের কার্যপরিধি নির্ধারন থেকে শুরু করে কর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সুবিধা যা তারা প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকেন যেমন – বাৎসরিক ছুটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসর ভাতা, বেতন, বোনাস প্রভৃতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে থাকেন এই বিভাগের কর্মকর্তারা। কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন এবং তাদের কাজের প্রেরণা সৃষ্টির জন্য দক্ষ কর্মীদের পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি যারা কর্মক্ষেত্রে অবহেলা করে তাদের সঠিক পরামর্শ প্রদানও এই বিভাগের কাজ।

প্রারম্ভিক বেতন কাঠামো

প্রতিষ্ঠানভেদে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এন্ট্রি লেভেল অফিসার হিসেবে আপনার বেতন হতে পারে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা, এর সাথে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকতে পারে। পরবর্তী পদোন্নতি নির্ভর করবে আপনার কাজের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার উপর।

কী ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যায়

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা পেশায় আসার আগে যেসব প্রতিষ্ঠানে এই বিভাগ রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখা উচিত। সাধারণত বড় বড় দেশী এবং বহুজাতিক কোম্পানি গুলোতে এ বিভাগের পরিপূর্ণ কার্যক্ষেত্র রয়েছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ব্যাংক, মিডিয়া হাউজ, ওষুধ কোম্পানী, প্রকাশনা সংস্থা, এনজিও, টেলিকমিউনিকেশন এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে এ বিভাগটির সুবিস্তৃত কার্যক্ষেত্র রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন পর্যন্ত মানব সম্পদ উন্নয়ন নামে কোনো বিভাগ না থাকলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে 'ট্রেইনিং'/ 'স্ট্যাটিসটিক্‌স'/ 'প্ল্যানিং' ইত্যাদি বিভাগগুলোতে মূলত মানব সম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কিত কাজগুলোই করা হচ্ছে। এই বিভাগগুলোর নীতিমালা তৈরী করে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়, এবং সরকার কর্তৃক তা অনুমোদিত হয়।

পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ

বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ, এমবিএ কোর্সের মধ্যে এইচআরএম বিষয়টি পড়ানো হয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে PGDHRM (Post Graduate Diploma in Human Resource Management) ডিগ্রি নেওয়া যায়। বর্তমানে বিভিন্ন চাকুরিদাতা এই ডিগ্রিকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখেন। যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তাদের মধ্যে কয়েকটি হল:

  • বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, সোবহানবাগ, মিরপুর, ঢাকা
  • বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ফার্মগেট, ঢাকা
  • ইনস্টিটিউট অব পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট, ফার্মগেট, ঢাকা এবং
  • বিয়াম ফাউন্ডেশন, নিউ ইস্কাটন, ঢাকা

এই প্রশিক্ষণগুলো ছয় থেকে নয় মাস ব্যপী হয়। এগুলোতে ভর্তি হওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম স্নাতক পাশ।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় পেশা, এর জন্য প্রস্তুতি নেওয়াও তুলনামূলক সহজ। তবে যেকোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করার আগে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া অত্যাবশ্যক। আপনার সঠিক সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত একটি উন্নত প্রতিষ্ঠানে আধুনিক চাকরির দরজা খুলে দিতে পারবে।

কী পড়ানো হয়?

ব্যবস্থাপনার সার্বিক নীতি, পদ্ধতি, মডেল ও তত্ত্ব পড়ানোর মাধ্যমে ব্যক্তি যেমন ব্যবসা পরিচালনা সম্পর্কে জানতে পারেন, তেমনি জানতে পারেন ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন পদ্ধতি—যা থেকে নিশ্চিতভাবে উপকৃত হচ্ছে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র। সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা রয়েছে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের একটি কথায় বিষয়টি ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন।’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ছাড়া যেমন সঠিক রোগ নির্ণয় সম্ভব নয়, তেমনি ব্যবস্থাপনার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান ছাড়া কার্যকর ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন স্মার্ট, যুগোপযোগী এবং আদর্শবান নেতা তৈরি করতে আমরা শেখাতে চাই ব্যবস্থাপনা। একটি প্রতিষ্ঠান যথার্থরূপে পরিচালনার প্রায় সবকিছুই এখানে পড়ানো হয়।

ভবিষ্যৎ কী?
বর্তমানে যেকোনো বিষয়ের তুলনায় ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ ভালো। বিশ্বায়নের যুগে যেকোনো দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলে গোটা বিশ্ব। প্রতিযোগিতাটাও অনেক বড়। তাই ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এই জটিল কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য ব্যবস্থাপনার বিশেষায়িত জ্ঞান অপরিহার্য। দিন দিন দেশে-বিদেশে ব্যবস্থাপনা ডিগ্রিধারীদের কদর বাড়ছে। পৃথিবীর বিবর্তনে ব্যবস্থাপনার গতি-প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে দক্ষ ব্যবস্থাপকের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। যত দিন পৃথিবী থাকবে, ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অস্তিত্ব তত দিন স্বমহিমায় বিরাজমান থাকবে।

ক্যারিয়ার কোথায়?
চাকরির বাজারে নিয়োগকর্তা শুধু ব্যক্তি নিয়োগ করেন না, নিয়োগ করেন তার দক্ষতাও। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকে সেই দক্ষতায় পারদর্শী করে তোলা হয়। তাই নিয়োগকর্তা নির্দ্বিধায় ওই দক্ষ কর্মীকে নিয়োগ করে লাভবান হতে পারেন। ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবস্থাপনার শিক্ষার্থীরা ব্যবসায়-বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত প্রকল্প—এককথায় সব ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার রয়েছে। ব্যবস্থাপনায় চাকরির সুযোগ ব্যাপক।

কারা পড়বে?
যদি তোমার থাকে নেতা হওয়ার নেশা, চলে এসো ব্যবস্থাপনায়। যারা স্বাধীন পেশায় থাকতে চায়, সমাজকে নেতৃত্ব দিতে চায়, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে চায়, সফল উদ্যোক্তা হতে চায় এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে—তারাই পড়বে ব্যবস্থাপনা।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.