গণিত কেন পড়ব – গণিত নিয়ে পড়ে ক্যারিয়ার কি | Muhammed Juwel Ahmed


স্কুল জীবনে সবাই মোটামুটি একটি কমন রচনা ইংরেজীতে লিখেছি আমরা, নাম, “এইম-ইন-লাইফ”, লিখতে গিয়ে আমাদের প্রায় সবারই উত্তর ছিল ডাক্তার হব, গ্রামে গিয়ে জনগণের সেবা করব, বিনা পয়সায় চিকিৎসা করব, অথবা ইন্জিনিয়ার হব, দেশের উন্নয়ন করব। কলেজের পর ভর্তি কোচিংও করেছি সেভাবেই। কিন্তু বিধি বাম বা দূর্ভাগ্য যাই বলিনা কেন, ভর্তি পরীক্ষায় অনিচ্ছাকৃত চান্স, গণিত বিভাগ। হায় কি হবে ভবিষ্যত ?! প্রথম বর্ষেই অনেকেই বিষয় পরিবর্তন করার জন্য ক্লাস বর্জন করে, হতাশায় ভুগে, নানান বিধ চিন্তা করে পুণঃভর্তি হয় সেই প্রথম বর্ষেই, মাঝখান থেকে জীবনের একটি বছর এমনিতেই যায়, আবার অনেকেই একই হতাশা বা অনীহা বয়ে বেড়ায় পুরু অনার্স জুড়ে, ফলে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল আসেনা। অথচ উন্নত দেশগুলোতে গণিত বিষয়টি সবচাইতে মেধাবীদের পছন্দের একটি বিষয় !! কারণটা কি?? সহজ উত্তর, সেসব দেশে ভাল চাকরী পাওয়া যায়, আমাদের দেশে যায়না, আসলে ধারণাটা ভুল !! আসব এই বিষয়ে, মূলত: আজ আমি দেখাব গণিতের ভবিষ্যত, দেশে ও বিদেশে।

প্রথমে দেশের কথায় আসি, গণিত পড়ে দেশেই ভাল কিছু করা যায়। যেমন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, ব্যাংক, করপোরেট অফিসগুলোতেও গণিতবিদ লাগেই। দেশে এখন ইউজিসির হিসাব অনুযায়ী ২৭ টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫৭ টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে গণিতের শিক্ষক লাগবেই, শিক্ষক সংকটের কারণে বেসরকারী বিশ্ববিদ‌্যালয় গুলো সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হায়ার করে খন্ডকালীন ক্লাসের ব্যবস্থা করতেছে, কারণ কোয়ালিটি সম্পন্ন জ্ঞান দান। কিন্তু এই খন্ডকালীন শিক্ষকের প্রয়োজন হতোনা যদি আমাদের দেশের গণিত নিয়ে পড়ার আগ্রহটা থাকে শুরু থেকেই আমাদের মাঝে, তাহলে রেজাল্ট ভাল হবে, গবেষণা পত্র থাকবে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখবে, মাস্টার্স পাশ একজন ছাত্র রেজাল্ট ভাল (সিজিপিএ ৩,৫০ এর উপর), ইন্টারনেশনাল জার্নালে গবেষণাপত্র আছে, তখন লুফে নিবে তাকে। আস্তে আস্তে চাহিদা বাড়বে। এখন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্মানীও খারাপ না, লেকচারার পদে ১৮,০০০ টাকা থেকে ৩৫,০০০ টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকে, এই সম্মানীও বাড়বে ভবিষ্যতে। সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপকের বেতন ৪০,০০০ টাকা থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেয় পর্যায়ক্রমে এখন, এটাও বাড়বে। তাছাড়া গবেষণা উপস্থাপনের জন্য পৃথিবীর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগতো থাকছেই, তাও বিনা খরচে অথবা স্বল্প খরচে !!! কিন্তু এর জন্য দরকার মান সম্পন্ন গবেষণা, তাও সেটা হবে তখনই যখন প্রথম বর্ষ থেকেই গণিতের খুঁটিনাটি বিষয়ে সিরিয়াস থাকতে হবে।

এবার আসি, ব‌্যাংকগুলোতে, হ্যাঁ এটা ঠিক, ব্যাংকগুলোতে ব্যাবসা বিষয়ে যারা পড়ে তাদের প্রাধান্য থাকে, কিন্তু ভাল ভাল ব্যাংকগুলোতে লাখ টাকার সম্মানীতে চাকরী করতেছে গণিতবিদরা। স্টাডি ট্যুর এর আয়োজন করতে গিয়ে দেখেছি, তাছাড়া শুরুতেই এসপিও বা এমপিও পদের জন্যও প্রচুর গণিতবিদ নিচ্ছে, সম্মানী ২০,০০০ টাকার উপরে। আস্তে আস্তে প্রমোশনতো আছেই। তাছাড়া হাউস লোন, কার লোন, বউ-এর গহনা লোন, স্বাস্থ্য চিকিৎসা লোন সহ অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকেই। আর বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল করপোরেট অফিসগুলোতেও গণিতবিদ লাগেই, তবে তাদের ধীরে ধীরে বুঝাতে হবে, গণিতবিদরা বিজনেস স্টাডিস নিয়ে যারা পড়েছে, তাদের বস !! আর এটা তখনই হবে যখন অনার্স প্রজেক্ট বা মাস্টার্স থিসিস এর সময় ইন্টার্নশীপ ব্যাবস্থা করে দেওয়া হবে সেই অফিস গুলোতে, যেটা বিজনিস ফ্যাকাল্টি করে থাকে, তাদের সাথে প্রতিযোগীতা করে এই যায়গাটি আমাদের পাকাপোক্ত করে নিতে হবে। ডেনমার্কের কোপেনহেগ বিজনেস স্কুল এর এমবিএ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত, আর সেখানে প্রথম ১ বছর পড়ানো হয়, লিনিয়ার এলজেবরা, মাল্টি ভ্যারিয়েবল ক্যালকুলাস, ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন, ফাংসনাল এনালাইসিস, টপোলজি। আমার এক আত্মীয় পড়ে সেখানে, সে আমাকে এই তথ্য দিয়েছে, আমি নিজে নর্থ সাউথ এ এম,বি,এ করছে এমন স্টুডেন্ট পড়িয়েছি, গণিত-ই সিলেবাস এর ৪ ভাগের ২ ভাগ। সুতরাং করপোরেট অফিসগুলোতে এই বার্তা পৌছাতে হবে, এর উত্তম মাধ্যম জব ফেয়ার করা বা সেমিনার করা।

এবার যেটা বলেছিলাম, বিদেশে গণিত পড়লে ভাল চাকরী পাওয়া যায়, তাই সেখানকার ভাল ভাল মেধাবীরা গণিত পড়তে চায়। কথাটা আংশিক সত্য, পরোপুরি না, মূলত: গণিত মানেই উন্নত দেশগুলোতে যেটা বুঝানো হয়, গবেষণা, আর গবেষণা বাবদ আছে প্রচুর অর্থ, এটাই চাকরী। এছাড়া আর সবই আমাদের দেশের মতই, এখানেও দেখতেছি আই-আর বিষয় নিয়ে পড়েও ব্যাংক এ চাকরী করতেছে। কিন্তু এদের গণিত পড়ার মূল আগ্রহ থাকে নিজেকে একটু আলাদা করে ভাবতে, গণিত পড়তে পারাটা এদের কাছে বিরাট সম্মানের। অনেকটা আমাদের দেশের ইন্জিনিয়ার বা মেডিকেল এ পড়তে পারার মত। কারণ, এরা অর্থের চাইতে সম্মানটা বড়, হয়ত অর্থ প্রচুর আছে তাই এমন ভাবে, কিন্তু এটা সত্যিই যে, গণিত বিষয়টা খুব কম ছেলে-মেয়েই সিলেক্ট করে। যারা করে তারা আলাদা চিন্তাবীদ। সে যাকগে, তাতে আমাগো কি?? আমাগো দেখা দরকার ফিউচার ইন বিদেশ, তাই তো ?? তবে বলি, পৃথিবীর সবচাইতে বেশি স্কলারশীপ এখন গণিতের গবেষণায়। বিশেষ করে আমেরিকা, কানাডা, জার্মানী, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ন্যাদারল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন সহ বড় বড় ভাল অর্থনীতির সব দেশে। কিছু কিছু স্কলারশীপ আছে শুধু গণিতবিদদের জন্যই, এই বিষয়ে আরেকদিন লিখব, আজ মেলা রাত হয়ে গেছে, শুধু শেষ করছি,

গণিত এমন একটা বিষয়, যেটা পড়লে জীবন অচল হবেনা কোনদিনই, সেটি দেশে হোক, বিদেশে হোক। মান নিয়ে একটু তারতম্য আছে, সেটা থাকতেই পারে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এই বিষয়টা খুলে বললে আশা করি হতাশা দূর হবে, প্লাস স্কুল-কলেজ পর্যায়েও এই সব বার্তা পৌঁছে দিতে হবে, অভিবাবকদেরও সচেতন করতে হবে। প্রত্যাশা বর্গমূল ডট কম এই কাজটি করবে, আমরা করব।

বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে গণিতের সাহায্যে প্রকাশ করে, গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বাস্তব সমস্যাগুলো গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে সমাধান করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগ রয়েছে। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান, বাণিজ্য অনুষদসহ অনেক অনুষদের শিক্ষার্থীদেরই গণিত বিভাগের অধীনে সম্পূরক কোর্স পড়তে হয়। তবে আজ আমরা কথা বলছি শুধু গণিত বিভাগ নিয়ে।

কী পড়ানো হয়

বীজগণিত, জ্যামিতি, ক্যালকুলাস, গাণিতিক বিশ্লেষণ, রৈখিক বীজগণিত, সংখ্যাতত্ত্ব, অন্তরীকরণ সমীকরণ ইত্যাদি স্নাতক পর্যায়ের প্রাথমিক কোর্স হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পড়ানো হয়। সম্পূরক বিষয় হিসেবে থাকে পরিসংখ্যান, পদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে কিছু ল্যাব কোর্স রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার করে গণিতের প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করার সুযোগ থাকে। এ জন্য কিছু ল্যাব কোর্স রয়েছে। এ ছাড়া সি, সি প্লাস প্লাস, ম্যাটল্যাবসহ বেশ কিছু প্রোগ্রামিং ভাষা শেখানো হয়।

অধিকাংশ বাস্তব ক্ষেত্রে গাণিতিক সমীকরণগুলোর সমাধানের সঠিক মান বের করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণে রেখে আসন্ন মান নির্ণয় করা হয় এবং এই পদ্ধতিকে সংখ্যাসূচক বিশ্লেষণ বলে। এই পদ্ধতিতে এলগরিদমের মাধ্যমে সমীকরণ সমাধান করা হয় এবং গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিচ্যুতির নিয়ন্ত্রণ এবং নিরূপণ করা হয়। হিসাব কষে বা ক্যালকুলেটরের মাধ্যমে মান নির্ণয় প্রায় অসম্ভব। তাই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে মান নির্ণয় শেখানো হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখার সমস্যাগুলোকে অন্তরীকরণ সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় এবং সমাধান করা হয়। এ জন্য তৃতীয় বর্ষে সংখ্যাসূচক বিশ্লেষণবিষয়ক কোর্স রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে অত্যানুকূল ফলাফল নির্ণয় করার অপরিহার্য বিষয় হিসেবে রৈখিক প্রোগ্রামিং কোর্স রয়েছে। এ ছাড়া বিমূর্ত গণিতের কোর্স হিসেবে বিমূর্ত বীজগণিত (অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যালজেব্রা), গ্রুপ তত্ত্ব (গ্রুপ তত্ত্ব) ইত্যাদি পড়ানো হয়।

চতুর্থ বর্ষে, আংশিক অন্তরীকরণ সমীকরণের তাত্ত্বিক ও সংখ্যাসূচক বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয় কোর্স হিসেবে ফাংশনাল অ্যানালাইসিস শেখানো হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানের গাণিতিক বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে অন্তরীকরণ জ্যামিতি ও টেনসর বিশ্লেষণ পড়ানো হয়। প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান, প্রবাহ বলবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে গুণগত বিশ্লেষণের জন্য কিছু কোর্স করতে হয়। এ ছাড়াও আরও নানা বিষয় থাকে। চতুর্থ বর্ষে গণিতের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণামূলক প্রতিবেদন লিখতে হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়েও উচ্চতর গাণিতিক বিশ্লেষণের বিভিন্ন কোর্স চালু রয়েছে। স্নাতকোত্তরেও গবেষণামূলক প্রতিবেদন বা থিসিস লিখতে হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে।

ক্যারিয়ার কোথায়

গণিত বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশা, বিশ্বব্যাপী উচ্চতর শিক্ষা (পিএইচডি) ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরি, ব্যাংক ও অন্যান্য করপোরেট চাকরিতেও গণিতের স্নাতক উর্ত্তীণ শিক্ষার্থীরা যুক্ত আছেন।

ভবিষ্যৎ কী

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ভবিষ্যতে মানুষ তাঁদের চাকরি হারাবে কি না, এটি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। তবে ভবিষ্যৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে গণিতের গুরুত্ব কোনো অংশে কমবে না। কারণ, এই যুগের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে গণিতের ভাষার ওপর নির্ভর করেই। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু মানুষের গণিত ব্যবহার কোনোভাবেই কম হবে না।

কারা পড়বে

গ্রিক গণিতবিদ আর্কিমিডিসের ভাষায়, ‘গণিত তার কাছেই তার সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়, যে বিশুদ্ধ মন ও ভালোবাসা নিয়ে গণিতের দিকে অগ্রসর হয়।’ সে ক্ষেত্রে বলা যায়, যেসব শিক্ষার্থী নিজেকে গণিতের জন্য সম্পূর্ণ উৎসর্গ করতে পারবে, তাদেরই এই বিভাগে পড়া উচিত। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষার্থীরা গণিতের দক্ষতা প্রয়োগ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের গুরুত্ব বাড়াতে সক্ষম হবে।



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.