স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা ও সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত – (বিস্তারিত আলোচনা) Muhammed Juwel Ahmed |
আমরা বহুকাল থেকেই নানা মানুষের কাছে শুনে আসছি, যে ‘ম্যারেজ ইজ এ সোশ্যাল ইনস্টিটিউশন’ অর্থাৎ, বিয়ে হল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
যেই প্রতিষ্ঠান সমাজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আইন, প্রথা, নিদর্শন এবং নিয়ম মেনে চলে, যা সমাজের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
আর, এই বিয়ে বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দুই প্রধান স্তম্ভ হল স্বামী এবং স্ত্রী।
আমাদের ভারতীয়দের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মনে করা হয়, যে এই স্বামী ও স্ত্রীয়ের মধ্যেকার যে সম্পর্ক তা কেবলমাত্র এক জন্মের নয়, বরং তা হল সাত জন্মের।
তবে, জন্ম যেকোনোই হোক না কেন, কেমন হওয়া উচিত একজন স্বামী ও স্ত্রীয়ের মাঝের সম্পর্ক ?
আজকে, আমাদের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো, ‘স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত ?’- এই বিষয়টি নিয়ে।
শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই কেন, যেকোনো সম্পর্কের প্রধান ভিত্তিই গড়ে ওঠে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদানের মাধ্যমে।
স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত ?
একেবারে দুটি ভিন্ন মানুষের পরস্পরের প্রতি সম্পর্কের সূচনা হয় বিবাহ নামক একটি আচার-অনুষ্ঠানের দ্বার।
যা দুটি মানুষ আজীবন রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি মেনে চলে।
একটি নতুন পরিবার গঠনে যেকোনো স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
তাই, এই সম্পর্কের মধ্যে চিরকাল ভালোবাসার টান ধরে রাখা মুখের কথা নয়।
এই কারণেই, আমাদের জানা উচিত, একজন স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার সম্পর্কটা ঠিক কেমন হলে তা সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ একটি সংসারের জন্ম দেয়, সে সম্বদ্ধে বিস্তারিতভাবে জানা –
১. একে অপরের মন বোঝা:
সাত পাকে বাঁধা পড়ার সময়ে যখন দুই মানুষের মধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয়, তখন স্বামী-স্ত্রীকে অগ্নি সাক্ষী করে একটি মন্ত্র বলতে হয়, “যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব”, যার অর্থ হল ‘আমার হৃদয় তোমার হল, তোমার হৃদয় আমার হল’।
বিবাহের পরের মুহূর্ত থেকে স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পরের মনের অধিকারী হয়ে ওঠে।
তাই, একটা সুস্থ ভালোবাসা সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে অন্যের মনকে বুঝতে পারা হল সুখে-শান্তিতে সংসার করার প্রথম চাবিকাঠি।
মানুষ শুধু-শুধু কখনওই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, এই জন্যে স্বামী ও স্ত্রীয়ের প্রয়োজন মন খুলে কথা বলা ও দুজনেই দুজনের মনের হদিশ জানা।
২. পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা:
দুইটি মানুষের মধ্যে শুধু মনের মিল থাকলেই চলে না, সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব বজায় রাখার।
সংসারে ঝগড়া-বিবাদও কিন্তু একটা প্রাত্যহিক ঘটনা।
কিন্তু, সবশেষে ভুলে গেলে চলবে না যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলা একদমই ভালো ব্যাপার নয়।
দুটি মানুষের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে গেলে অবশ্যই একে অপরকে শ্রদ্ধার সাথে মিশতে হবে।
৩. গোপনীয়তা রক্ষা করা:
একটা স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক কিন্তু ভালো ও সুন্দর একটা পার্টনারশিপের মতো।
যেখানে, সঙ্গীর ভালো-খারাপ, দুর্বলতা সবই জানতে হয়, কিন্তু সংসারে ভালো থাকতে গেলে দুজনেরই উচিত পরস্পরের মধ্যে গোপনীয়তা রক্ষা করে, আদর্শ সঙ্গীর মতো একে অপরকে রক্ষা করে এগিয়ে চলা।
একটা সুস্থ বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয় হল, একে অন্যের গোপনীয়তাকে সম্মান করা ও তাদের বিশ্বাস বজায় রাখা।
৪. মনোযোগ সহকারে একে অন্যের কথা শোনা:
বেশির ভাগ বৈবাহিক ঝগড়া-অশান্তির সূত্রপাতই হয় মন দিয়ে কথা না শোনার ফলে।
তাই, আপনাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ধরে রাখতে গেলে অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে আপনার সঙ্গীর মনের কথা শুনুন ও ভেবে-চিন্তে সেই কথার উত্তর দিন।
বৈবাহিক সম্পর্কে একজন ভালো শ্রোতা থাকা কিন্তু একান্ত প্রয়োজনীয়।
৫. নিবিড় বন্ধনের প্রতিশ্রুতি:
বিয়ে হল এমন এক আচার যার মাধ্যমে আপনি আপনার জীবনসঙ্গীকে আপন করে নেন।
আর, যখন আপন করেই নেন, তখন আপনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন, যে যেকোনো পরিস্থিতিতেই আপনি আপনার সঙ্গীর পাশে থাকবেন এবং যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা দুজনে একসাথেই করবেন।
৬. সমান গুরুত্ব ও অধিকার প্রদান:
মানুষ যখন বিয়ে করে তখন দুটি মানুষের শরীর ও মনের পাশাপাশি, যাবতীয় ব্যাপারেই দুজনই দুজনকে সমান অধিকার প্রদান করার কথায় সম্মত হয়।
তাই, স্বামী ও স্ত্রী একটি সংসার তৈরি ও পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যপারে সমানভাবে অধিকারী।
তাই, একটি স্বামী-স্ত্রী ভালোবাসার সম্পর্কে সবসময় উচিত একে অন্যের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে, সমান অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সংসার পরিচালনা করা।
৭. সুখ প্রদানের অঙ্গীকার:
জীবনে চলার পথে সুখ-দুঃখ অবশ্যই থাকবে।
তবে, একে অন্যের কাছে সুখ প্রদানের অঙ্গীকার কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
তা স্বামী হোক বা স্ত্রী, দুজনেরই উচিত দুজনের সুখ-দুঃখের যাবতীয় দায়িত্ব একে অপরের কাঁধে তুলে নেওয়া।
সংসারে দিনের শেষে সুখে ও শান্তিতে থাকাটাই আসল ব্যাপার।
৮. পরস্পরের প্রতি যত্নশীল হওয়া:
যতক্ষণ আমরা ছোট থাকি, আমাদের অভিভাবকেরা আমাদের যত্ন-আত্তির দায়িত্ব নিয়ে থাকেন।
কিন্তু, যখন আমরা বড় হয়ে কোনো বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হই, তখন আমাদের যত্ন-দায়িত্ব সবকিছু বর্তায় আমাদের স্বামী বা স্ত্রীয়ের উপর।
এই কারণেই, আমাদের উচিত পরস্পরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হওয়ার পাশাপাশি একে অন্যের প্রতি যত্নশীল থাকা।
৯. একসাথে সমস্যার সমাধান খুঁজুন:
জীবন একটা অনিশ্চিত যুদ্ধের মতো আর এই যুদ্ধে আপনার সঙ্গী হল আপনার স্বামী বা স্ত্রী।
তাই, আপনি কোনো সমস্যাতে পড়লে অবশ্যই আপনার জীবনসঙ্গীকে পাশে রেখে সেই সমস্যার মোকাবিলা আপনারা একসাথে করুন।
এতে আপনাদের দুজনের সম্পর্কের দৃঢ়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।
১০. পরস্পরের বিশ্বাস বজায় রাখুন:
অনেক সময়ই স্বামী ও স্ত্রীয়ের সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায় অবিশ্বাস।
শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্কই নয়, বরং অবিশ্বাস যেকোনো সম্পর্ককেই নিমেষে শেষ করে দিতে পারেন।
তাই, স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে কখনওই অবিশ্বাসকে দানা বাঁধতে দেবেন না।
প্রয়োজন হলে, সঙ্গীর সাথে কোনো বিষয়ে সন্দেহ থাকলে সরাসরি কথা বলুন, নিজের মনে কোনো নির্দিষ্ট ধারণা তৈরী করার আগে।
এর ফলে, আপনাদের সম্পর্কের মধ্যেকার বিশ্বাসটা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
১১. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ:
হাজার ঝামেলা হোক কিংবা ঝগড়া, কোনোভাবেই আপনাদের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির মতামত দাবি করে তাকে আপনাদের সমস্যার মধ্যে প্রবেশ করতে দেবেন না।
বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির হস্তক্ষেপে সমস্যার জটিলতা আরও বেড়ে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে।
তাই, চেষ্টা করবেন নিজেদের মধ্যেকার সমস্যা নিজেরাই মিটমাট করে নিতে।
১২. বন্ধুর মতো মেলামেশা করুন:
আমরা আমাদের বন্ধুদের সাথে যেমন খোশ-মেজাজে আর অকপটে মনের কথা বলতে পারি, ঠিক তেমনই আপনার জীবনসঙ্গীর সাথে মন খুলে আলাপ-আলোচনা করুন।
দেখবেন, এতে আপনাদের সম্পর্কের অনেক জটিলতা এমনিতেই দূর হয়ে গেছে।
বন্ধুত্বপূর্ণ বিয়ের সম্পর্কগুলো অনেকটাই বেশি গভীর ও মজবুত হয়।
১৩. ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অনুচিত:
আপনার সঙ্গী যদি নিজের মতো করে কিছু সময় কাটাতে চায় কিংবা নিজের জন্যে যদি ভালো কিছু করতে চায়, অবশ্যই তাকে উৎসাহিত করুন এবং তার পাশে থাকুন।
কারণ, সে আপনার স্বামী বা স্ত্রী হলেও তার নিজস্ব একটা পরিচিতি আছে এবং সেই পরিচিতিটাকে সম্মান করতে শিখুন।
কোনো সম্পর্ক মানেই সেটা অদৃশ্য তারের বাঁধন একেবারেই নয়, তাই প্রতিটা মানুষেরই ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকাটা জরুরি।
এতে, সংসারের সুখ-শান্তি বজায় থাকে।
১৪. সবশেষে, গভীরভাবে ভালোবাসুন:
ভালোবাসার অভাব যেকোনো সম্পর্কের মধ্যেই ইতি টানতে পারে।
তাই, নিঃস্বার্থভাবে নিজের সঙ্গীকে ভালোবাসুন এবং তার প্রতি অনুগত থাকার চেষ্টা করুন, কারণ ভালোবাসতে গেলে কিন্তু একজন মানুষই যথেষ্ট।
এই কারণেই স্বার্থহীন ভালোবাসাই হল স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার মূল চাবিকাঠি।
আমাদের শেষ কথা,,
আমাদের আজকের স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
লেখাটি ভালোলাগলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।
এছাড়া, আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে, সেটাও নিচে কমেন্ট করে জানাবেন।
কোন মন্তব্য নেই